আন্তর্জাতিক রাজনীতির নির্মমতাঃ স্থায়ী শত্রু বা স্থায়ী মিত্র বলে কিছু নেই, আছে স্থায়ী স্বার্থ (পর্ব-১)
===============================
.
বেশী দিন অাগের কথা নয়। মাত্র ১১৩ বছর পূর্ব অর্থাৎ ১৯০৫ সাল থেকে শুরু। ভ্লাদিমির লেনিন এবং আলেকজান্ডার বগদানভ এর গড়া বলশেভিক দল ১৯০৫ সাল নাগাদ একটি গণসংগঠনে পরিণত হয়। তখন দলটির সদস্য হয়েছিল শ্রমিক জনগোষ্ঠী যা এক ধরণের গণতান্ত্রিক নীতিতে পরিচালিত হতো। তারা নিজেদেরকে রাশিয়ার বিপ্লবী শ্রমিক শ্রেণীর নেতা হিসেবে বিবেচনা করতো। তাদের বিশ্বাস ও কার্মকান্ডকে বলা হতো বলশেভিকবাদ ।
.
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ার জার সরকার অংশ নিয়েছিলো লাভ-ক্ষতির একটা ফর্দি দাড় করে। তবে যুদ্ধের ব্যয় মেটাতে গিয়ে সাধারণ জনগণের জীবন-যাত্রার দিকে বেখেয়ালি হয়ে গিয়েছিল। পরিণামে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানীর হাতে দারুন মার খায় অাজকের দিনের রাশিয়া। মারের চোটে দিশেহারা রাশিয়া ২৮শে ফেব্রুয়ারী,১৯১৭, জার সম্রাট নিকোলাস-২ কে ট্রেন হতে গ্রেফতার করে। এই সুযোগে রাশিয়াতে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় স্যোসালিস্ট এবং লিবারাল ডেমোক্রাটরা কোয়ালিশন সরকার গড়েন। আলেক্সজান্ডার গুচকভের প্রগ্রেসিভ ব্লক এবং স্যোসালিস্টদের “সোভিয়েট পেট্রোগাড (শ্রমিক কাউন্সিল)” মার্চের পহেলা তারিখে প্রথম অর্ডারে ক্ষমতা ভাগাভাগি করেন। গুচকভ সরকারের প্রধান হলেন-কিন্ত সোভিয়েতে অনুমতি ব্যাতীত কোন মিলিটারী অর্ডার পাশ করাবার ক্ষমতা তার রইল না।
.
১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারীতে বিপ্লবের দিনে বলশেভিক পার্টি নিষিদ্ধ ছিল। অার বিপ্লবের নেতা লেনিন এবং লিওন ট্রটস্কি উভয়ে ছিলেন রাশিয়া থেকে নির্বাসিত। লেলিন ঘরে ফিরলেন তেশরা এপ্রিল। সোভিয়েতের নির্দেশেই তার ওপর হতে নিধেষাজ্ঞা উঠল। এমনকি ট্রটস্কি যখন রাশিয়াতে ফিরতেছিলেন-তাকে বৃটেন গ্রেফতার করা সত্ত্বেও ট্রটস্কিকে উদ্ধার করে দেশে আনা হল।
.
স্বাভাবিকভাবেই দুটো প্রশ্নের উত্থান হয়।
• কেন এ দু-জন সমাজতান্ত্রিকের পুনর্বাসন করা হল?
• কোন স্যোসালিস্ট প্রেমী সোভিয়েতের ক্ষমতার মসনতে বসল?
.
ইরাকি জেরেটালি, মেনশেভিক পার্টি সোস্যালিস্টদের তথা সোভিয়েতের নেতৃত্বে এবং ক্ষমতার গদিতে। এছাড়াও রাশিয়ান স্যোস্যালিস্ট রিভোল্যুশনারী পার্টি (SRP) বিপ্লবে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল। এরাই সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন লেনিন, ট্রটস্কি, কার্মানভ, স্টালিন প্রমুখ বলশেভিক মহারথীদের দেশে ফেরানোর ব্যাপারে।
.
এদিকে জার সম্রাট নিকোলাস-২ কে ট্রেন হতে গ্রেফতার হওয়ার মাধ্যমে জার শাসনের অবসান ঘটল। বলশেভিকদের অতীত শত্রু ধ্বংস হওয়ায়, ভাবা হয়েছিল লেনিন সহ বাকী বলশেভিকরা সবাই সোভিয়েত তথা স্যোসালিস্ট আন্দোলনকে শক্তিশালী করবেন। মহারথীগণ তো তাদের ইচ্ছা ষোলকলা পূর্ন করেই ছিলেন; তবে, মহামানব লেলিন পুনর্বাসনের কৃতজ্ঞতা বিশ্ববাসীকে অভিনব কায়দায় জানালেন - "মেনশেভিকদের হত্যা করে" । গুরু লেলিন এখানেই থামলেন না, তাদের অারেকটু সম্মানীত করার জন্য সরকারি ইতিহাসে "বুর্জোয়া ভিলেন" হিসেবে চিহ্নিত করলেন।
.
১৯১৭ সালের জুলাই মাসে বিপ্লবী সোস্যালিস্ট পার্টির #কেরেনাস্কী সরকারের প্রধান হন এবং বলশেভিকরা সোভিয়েতের মাধ্যমে ক্ষমতা ভোগ করতে থাকেন। তবে লেনিন নিরঙ্কুশ ক্ষমতার মোহে নেশাগ্রস্থ হয়ে কেরেনাস্কির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করেন এবং কেরেনাস্কি তা সফল ভাবে দমন করেন। লেনিন লেজগুটিয়ে ফিনল্যান্ডে পলায়ন করেন। এ সসময় নানাবিধ কারণে কেরেনাস্কির জনপ্রিয়তা হ্রাস পেতেছিল। অার বলশেভিকদের জনপ্রিয়তা তাদের “শান্তি, রুটি এবং চাকরী” শ্লোগানে দ্রুতই বৃদ্ধি পেতেছিল এমন কোন প্রমান পাওয়া যায় না। তাই পেট্রোগাডের অভ্যুত্থান কেরেনাস্কি অতি সামান্য সৈন্যবলেই দমন করতে পেরেছিলেন।
.
আলেক্সন্ডার কেরেনাস্কি কাজ়াণ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেনিনের ভূতপূর্ব শিক্ষক ফ্রিওডরের সন্তান। আইনের স্নাতক কেরনাস্কি তৎকালীন রাশিয়ার সেরা বক্তা, নিখাদ গণতন্ত্রপ্রেমী এবং উদারনৈতিক রাজনীতিবিদ ছিলেন। বলশেভিকদের সাথে তার দূরত্ব তৈরী হলে, লেনিন ক্যু ঘটাবার চেষ্টা করেন। এখানে লেনিন কেরেনাস্কিকে ‘বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক‘ না গণ্য করে “পুঁজিবাদের” সমর্থকদের দলে ফেলেন। এর কারন কেরেনাস্কি যুদ্ধ হইতে রাশিয়ান সেনা সরালেন না। বৃটেন এবং ফ্রান্সের সমর্থনে যুদ্ধ চালাতে থাকলেন । ফলে লেনিন তার “পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদের সর্বোচ্চ স্তর” এই তত্ত্ব অনুসারে পুঁজিবাদী ঠাওরাইলেন। তবে ঐতিহাসিকরা নিশ্চিত হয়েছেন যে, যুদ্ধ বন্ধ করিলে ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্স হতে যে খাদ্য এবং অর্থ সাহায্য আসতেছিল তা বন্ধ হত । জার্মানী রাশিয়ার অনেক জমি দখল করত । অর্থাৎ, কেরেনাস্কির বিচক্ষণতা এখানেও লক্ষণীয়।
.
১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের একটি অংশ হল বলশেভিক বিপ্লব যা অক্টোবর বিপ্লব নামেও পরিচিত। এটি জুলিয়ান বর্ষপঞ্জী অনুসারে ২৫ অক্টোবর ১৯১৭ এবং গ্রেগোরিয়ান বর্ষপঞ্জী অনুসারে ৭ নভেম্বর ১৯১৭ তারিখে সেন্ট পিটার্সবার্গে একটি সশস্ত্র অভ্যুত্থানের দ্বারা সংঘটিত হয়েছিল। বলশেভিকদের এ অক্টোবর বিপ্লবের দ্বারা সোভিয়েত ইউনিয়নের সৃষ্টি হয়।
.
এরপর সুনির্দিষ্টতা নিরূপনে সাদাসিধে ভাষায় লেনিন ঘটনাবলীর সারসংক্ষেপ করলেনঃ
''যে শ্রমিক ও কৃষক বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তার কথা বলশেভিকরা সর্বদা বলে এসেছে তা ঘটল'। অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক মহাবিপ্লব ছিলো সামাজিক বিকাশের, একচেটিয়া পুঁজিবাদের পরিস্থিতিতে শ্রেণিসংগ্রামের নিয়মসঙ্গত উপায়। এর বিজয়ে দেখা দিলো পৃথিবীতে প্রথম সমাজতন্ত্র অভিমুখী রাষ্ট্র" ।
.
এ প্রসঙ্গে একটি কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে অাজকের অালোচনা শেষ করব, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লর্ড পামারস্টোন এর সেই বিখ্যাত উক্তি—
"স্থায়ী শত্রু বা স্থায়ী মিত্র বলে কিছু নেই, আছে স্থায়ী স্বার্থ" ।
.
মেনশেভিকদের সাথে বলশেভিকদের সম্পর্কে রূঢ়তা বা মৌনতা যাই থাকুকনা কেন? কেরেনাস্কি ভাল-মন্দ যাই করুক না কেন? যুগে যুগে তারাই শেষ হাসি হাসে যারা পামারস্টোনের উক্তির সাথে সমান্তরালে চলে।