বিসিএস লিখিত + ভাইভা
মুজিবনগর সরকারের বাংলাদেশকে ভারত কেন সহায়তা করলো? কেন এতো বড় ঝুঁকি নিল, কী তাদের স্বার্থ
ছিলো, শুধুই কি মুজিব-ইন্দিরা সম্পর্ক, নাকি অন্য কিছু? তাদের
ঝুঁকিটাই বা কী ছিলো?
ভারতের ইতিহাসে সবথেকে ভয়াবহ ঝুঁকিটা নিয়েছিলো ১৯৭১
সালে। মানে ইতিহাসের সামান্য এদিকওদিক হলেই তৎকালীন
সময়ের দুই দানব আমেরিকা চীনসহ পাকিস্তানের হাতে ভারত
বিধ্বস্ত হতো! বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত ভারতের অনেকগুলো প্রদেশ!
আর যুদ্ধক্ষেত্র আমাদের প্রাণের বাংলা হয়ে যেত একখণ্ড
ফিলিস্তিন!
একাত্তরে বাংলাদেশি শরণার্থীর চাপ ছিল ভারতের জন্য সব
থেকে দুশ্চিন্তার বিষয়। প্রায় ১ কোটি শরণার্থী আশ্রয় নেয়
পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরার মতো দরিদ্রপ্রবণ সীমান্ত
অঞ্চলগুলোতে। এটাই ছিলো তৎকালীন বিশ্বের সব থেকে বড়
শরণার্থী সমস্যা। ভারত জানতো এই সমস্যা বছর খানেকের
বেশি থাকলে তাদের আর্থসামাজিক অবস্থা শোচনীয় হয়ে
যাবে। এমনকি কিছু কিছু জায়গায় শরণার্থী ও স্থানীয়দের
মধ্যে খাবার ও বাসস্থান নিয়ে সংঘর্ষও হয়েছিলো, যা
ইন্দিরার দুশ্চিন্তা আরো বাড়িয়ে দেয়। খোদ ইন্দিরা সরকারই
শরণার্থী নিয়ে ভারতে রক্ষণশীল দলগুলোর প্রবল বিরোধীতার
মুখে পড়েছিলো। সমস্যার দ্রুত সমাধান না করতে পারলে
পরবর্তী নির্বাচনে কংগ্রেস নিশ্চিত পরাজিত হবে, এই
আশংকাও তীব্র হচ্ছিলো।
১৯৬৭ থেকে ৭৩ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে উগ্র বামপন্থী নকাশালের
সশস্ত্র বিদ্রোহ চলছিলো। শুধু এজন্যই একাত্তরের সেপ্টেম্বর
পর্যন্ত বাংলাদেশের কোন বামপন্থিকেই গেরিলা ট্রেনিং
নিতে দেয়নি ইন্দিরা সরকার। তাদের ভয় ছিল, এই বামদের হাত
গড়িয়ে নকশালদের কাছে অস্র চলে যাবে, এমনকি এরা নকশাল
আন্দোলনেও যোগ দিতে পারে। সুতরাং বাংলাদেশের
অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি দ্রুত স্থিতিশীল না করতে পারলে
পশ্চিমবঙ্গ আরো বেশি অস্থিতিশীল হয়ে যাবে, এই আশংকা
তাদের ছিলো।
মুজিব-ইন্দিরার রাজনৈতিক মতাদর্শ ছিলো প্রায় অভিন্ন।
ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র কাঠামোতে ছিলো তাদের অগাধ
বিশ্বাস। দুজনই দীর্ঘ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বেড়ে
উঠেছিলেন এবং সামরিক শাসনের বিপক্ষে ছিলেন। তৎকালীন
পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে ভারতের বৈরি সম্পর্ক মুজিব-
ইন্দিরা সম্পর্ককে আরো সহযোগিতামূলক করে তোলে। মার্চে
পাকিস্তানিদের বর্বরোচিত হামলার পর তাজউদ্দীন যখন
এপ্রিলের শুরুর দিকে ইন্দিরার সাথে দেখা করেন, মুজিববিহীন
সময়ে তাজউদ্দীনের সাংগঠনিক দক্ষতায় ইন্দিরা কিছুটা
আশ্বস্ত হন। সে সময় অনেক ভারতীয় রক্ষণশীল নেতা ও দল
বিভিন্ন ভাবে প্রচার করছিলেন, ভারতের উচিত হবে
বাংলাদেশকে পূর্ণ স্বাধীন না করে সামরিক ও রাজনৈতিক
অস্থিতিশীলতা যতটা সম্ভব দীর্ঘায়ত করা। কারণ অর্থনৈতিক
ও সামরিক ভাবে একটি ভঙ্গুর পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন
বাংলাদেশ থেকে কম ঝুঁকিপূর্ণ। রক্ষণশীলদের এমন মনোভাবের
পরও ইন্দিরা মুজিবের বাংলাকে সহযোগিতা করার সিদ্ধান্তে
অটল ছিলেন। বাংলাদেশকে স্বাধীন করে পাকিস্তানি
সামরিক শাসকদের কিছুটা শিক্ষাও দিতে চেয়েছিলেন।
পাশাপাশি মুজিবের মিত্র দেশ ভবিষ্যৎ ভৌগলিক
রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে কাজ করবে, এটাও
হয়তো ইন্দিরা ভেবেছিলেন।
একাত্তরের জুন-জুলাইয়ের দিকেই ভারত বুঝতে পারে যে
সামরিক সমাধান ছাড়া শরণার্থী প্রত্যাবর্তন অসম্ভব, তারপরও
তারা জাতিসংঘে ও বহির্বিশ্বে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে
যেতে থাকে। ইন্দিরা তাঁর সেনাপ্রধানকে সামরিক
হস্তক্ষেপের সম্ভাব্যতা যাচাই করতে বললে সেনাপ্রধান
নভেম্বর-ডিসেম্বরের শীতের আগে তা সম্ভব নয় বলে সাফ
জানিয়ে দেন। কারণ জুন-জুলাইতে আমেরিকা পাকিস্তানের
মধ্যস্থতায় চীনের সাথে কূটনীতিক যোগাযোগ শুরু করে। তারপর
আমেরিকা ভারতকে জানিয়ে দেয় পাকিস্তান ইস্যুতে চীন
ভারত আক্রমণ করলেও আমেরিকা নিরপেক্ষ থাকবে। চীন
ভারতের 'চিকেন নেক' খ্যাত শিলিগুড়ি সীমান্ত দিয়ে আক্রমণ
করলে তাদের পুরু সেভেন সিস্টার্সই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। তাই
শীতে ভারত-চীন সীমান্তের গিরিখাতগুলো বরফে ঢাকা
পড়লেই কেবল ভারত সামরিক সমাধানের দিকে যেতে পারে।
আমেরিকা-পাকিস্তান-চীন জোটের কাছে ভারত যখন
নিজেকে নিঃসঙ্গ অসহায় দেখলো, তখন অনেকটা বাধ্য হয়েই
ভারত আগস্টে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে মৈত্রী চুক্তি করে।
এই মৈত্রী চুক্তির পরপরই চীন কিছুটা চুপ হয়ে যায়, কারণ চীন-
সোভিয়েত সীমান্ত উত্তেজনার জের ধরে সোভিয়েতের ৪৬-৫০
ডিভিশন সেনা চীন সীমান্তে আগে থেকেই অবস্থান করছিলো।
ডিসেম্বরের ৩ তারিখ যখন পাকিস্তান ভারতের পশ্চিম
সীমান্তে আক্রমণ করে বসে, ইন্দিরা খবরটা শোনলেন এক
জনসভায় বক্তৃতা দেবার মাঝে। ইন্দিরা চাচ্ছিলেন পাকিস্তান
যেন আগে থেকেই ভারত আক্রমণ করে বসে, তাহলে পরিস্থিতির
দ্রুত সামরিক সমাধানের জন্য মৈত্রী বাহিনীর নামে ভারতের
সেনাদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠাতে আর কোন
কূটনীতিক বাধা থাকবে না।
ভারতীয় সেনা বাংলাদেশে প্রবেশের পর ইন্দিরা যখন
আমেরিকান সপ্তম নৌবহরের দক্ষিণ চীন সাগর হতে মালাক্কা
প্রণালী হয়ে বঙ্গোপসাগর অভিমুখে যাত্রার খবর পান, কিছুটা
বিচলিত হয়ে পড়েন। কারণ তিনি আমেরিকা-চীনের সম্মেলিত
আগ্রাসনের সম্ভাব্য ভয়াবহতা সম্পর্কে জানতেন। সেই মুহূর্তে
সোভিয়েত ইন্দিরাকে আশ্বস্ত করে যে, ভারত মহাসাগরে
তাদের ৬ টি সাবমেরিনসহ ১৫/১৬ টি যুদ্ধজাহাজ আগে থেকেই
অবস্থান করছে। ঘটনার নাটকিতা শুরু হয় যখন চীন হুট করে
আমেরিকাকে জানিয়ে দেয় এ মুহূর্তে তারা কোন সামরিক
আগ্রাসনে যেতে পারবে না। আমেরিকা তড়িঘড়ি করে
জাতিসঙ্গে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব আনে এবং ইন্দিরা
সোভিয়েতের ভেটো ক্ষমতায় তা নাকচ করে দেন। সপ্তম নৌবহর
তখন মালাক্কা প্রণালীতে প্রায় ২৪ ঘণ্টা থেমে থাকে। বলা হয়
যে, যদি সেদিন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাশ হতো, তাহলে হয়তো
আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ আজ ফিলিস্তিনির মতো যুগের পর
যুগ পরাধীন থেকে যেতো।
১৬'ই ডিসেম্বর যখন স্বাধীন বাংলাদেশের সূর্যোদয় হয়, ঠিক
তখনই আমেরিকার সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরের জলসীমায়
প্রবেশ করে। ধ্বংসাত্মক সব অস্রে সজ্জিত সপ্তম নৌবহরকে
সাক্ষী রেখেই প্রায় আড়াই লক্ষ মা-বোনের ইজ্জত ও ত্রিশ
লক্ষ প্রাণের রক্ত স্রোতে ভেসে উঠলো আমার সোনার
বাংলাদেশ।
।
© কামরুল হাসান ইমন, শাহজালাল হল, চবি।