BCS পরীক্ষার্থীদের জন্য -

মুজিবনগর, প্রবাসী সরকার, মার্চের প্রকৃত অবস্থা

বিসিএস ভাইভা প্রস্তুতি
এই আর্টিকেল থেকে মুজিবনগর, প্রবাসী সরকার, মার্চের প্রকৃত অবস্থা জানতে পারবেন।
এই আর্টিকেল ২৬ মার্চ ২০১৫, প্রথম আলোতে ছাপানো হয়েছিল।
[একাত্তরের মার্চ থেকে প্রবাসী সরকার]
→এম আমীর-উল ইসলাম |
তাজউদ্দীন আহমদ ঢাকা ছাড়লেন। এরপর সীমান্ত পেরোনো, প্রবাসে রাজনৈতিক নেতাদের সমন্বয়, ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ, মুজিবনগর সরকার। ইতিহাস পাল্টানো সেসব দিনে তাজউদ্দীন আহমদের নিত্যসঙ্গী আমীর-উল ইসলামের স্মৃতিচারণ
১৯৭০ সালের নির্বাচনে উভয় পরিষদে (পাকিস্তান গণপরিষদ ও পাকিস্তান আইন পরিষদ) নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করার পর ৩ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে লাখো মানুষের সমাবেশে বঙ্গবন্ধু জনপ্রতিনিধিদের ছয় দফাভিত্তিক সংবিধান প্রণয়নে অনুগত থাকার জন্য শপথ পাঠ করান।
১৫ ফেব্রুয়ারিতে সংসদীয় দলের সভায় বঙ্গবন্ধুকে গণপরিষদের নেতা ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপনেতা নির্বাচিত করা হয়। একই সভায় অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে চিফ হুইপ এবং আবদুল মান্নান ও আমাকে হুইপ নির্বাচিত করা হয়।
ইয়াহিয়া খান ঢাকায় ৩ মার্চ গণপরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন।
ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধু ড. কামাল হোসেন ও আমাকে ছয় দফাভিত্তিক সংবিধান রচনা করার দায়িত্ব দেন। ছয় দফার অর্থনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য দুটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও তাদের সমন্বয় এবং বৈদেশিক মুদ্রা ও বৈদেশিক বাণিজ্যে উভয় পাকিস্তানের ক্ষমতার সমন্বয় সাধনকল্পে পরামর্শ গ্রহণের জন্য ড. নূরুল ইসলাম, অধ্যাপক রেহমান সোবহান, অধ্যাপক মুশারফ হোসেন, ড. স্বদেশ বোস ও আনিসুর রহমানের পরামর্শ নেওয়া হতো।
বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন আহমদ প্রায়ই আওয়ামী লীগ অফিস থেকে বেরিয়ে আমাদের সঙ্গে সময় দিতেন। আমরা সে সময় মতবিনিময় ও বিভিন্ন বিষয়ে তাঁদের পরামর্শ নেওয়ার সুযোগ পেতাম।
এভাবে কাজ করার পর ছয় দফাভিত্তিক খসড়া সংবিধান যখন চূড়ান্ত হয়েছে, সে সময় ইয়াহিয়া খানের ডাকা ৩ মার্চ অনুষ্ঠেয় গণপরিষদের বৈঠকে পেশ করার আগে পুরানা পল্টনের অফিসে আমাদের খসড়া সংবিধান অনুমোদনের কাজ তখন প্রায় শেষ। পূর্বাণী হোটেলে গণপরিষদের পার্লামেন্টারি পার্টিতে ডাকা উভয় পরিষদের সদস্যদের সমাবেশে যাওয়ার জন্য যখন প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখনই রেডিওতে ইয়াহিয়া খানের ঘোষণা শোনা গেল। তিনি ৩ মার্চ গণপরিষদের সভা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেছেন।
১ মার্চ বঙ্গবন্ধুর গাড়িতে করে আমরা পূর্বাণী হোটেলে রওনা হলাম। সামনে বঙ্গবন্ধু। পাশে হাজি গোলাম মোরশেদ গাড়ি চালাচ্ছেন। পেছনে ড. কামাল হোসেন ও আমি। আমার কাছে একটি বাঁধানো খাতা। আরেকটি খাতা পূর্বাণী হোটেলে জনপ্রতিনিধিদের উপস্থিতির জন্য।
এরই মধ্যে ঢাকার রাস্তা আর অলিগলি লোকে লোকারণ্য। সরকারি-বেসরকারি অফিসের কেরানি, পিয়ন, কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, দোকানদার, ছাত্র, যুবক থেকে শুরু করে স্টেডিয়ামে পাকিস্তান ক্রিকেট টেস্ট ম্যাচ বন্ধ হয়ে যাওয়া দর্শক-খেলোয়াড় সবাই পল্টন ময়দানে। প্রায় লাখো মানুষের সমাবেশ।
এমন অবস্থায় আমি দ্রুত দুটি প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করে বঙ্গবন্ধুকে দেখালাম। তাতে ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতার সঙ্গে কোনো আলাপ-আলোচনা ছাড়াই সর্বোচ্চ পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করায় নিন্দা প্রস্তাব। পরিবর্তিত অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে একক সিদ্ধান্ত দেওয়ার সমস্ত ক্ষমতা দেওয়া হয়। প্রস্তাবে বলা হয়, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের সকল নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে সর্বময় ক্ষমতা অর্পণ করা হয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তিনি যে সিদ্ধান্ত দেবেন, তা-ই বাংলাদেশ গণপরিষদের সিদ্ধান্ত বলে গণ্য হবে।’ তিনি যে সিদ্ধান্ত নেবেন, তা-ই এই পরিষদের সিদ্ধান্ত বলে গণ্য করা হবে। মুহুর্মুহু করতালির মাধ্যমে সর্বসম্মতিতে সিদ্ধান্তটি গৃহীত হয়। এরই ভিত্তিতে নির্বাচিত ওই দুটি পরিষদের সদস্যরা গণপরিষদে পরিণত হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই পরিষদই বাংলাদেশের সংবিধান রচনা করে।
পূর্বাণী হোটেল থেকে স্টেডিয়াম পর্যন্ত উপচে পড়া ভিড়। দেশি-বিদেশি সাংবাদিকের ভিড়ে পূর্বাণী হোটেলের লবি থেকে হোটেল-প্রাঙ্গণ পর্যন্ত উপচে পড়েছে।
স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত নগর।
ছয় দফা না এক দফা/ এক দফা, এক দফা
পিন্ডি না ঢাকা/ ঢাকা, ঢাকা
তোমার আমার ঠিকানা/ পদ্মা মেঘনা যমুনা
তুমি কে আমি কে/ বাঙালি বাঙালি
বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো/ বাংলাদেশ স্বাধীন করো।
এর পর শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। বঙ্গবন্ধু ৩ মার্চে ছাত্র-জনতার সমাবেশে বক্তব্য দেন। ৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানে তিন লক্ষাধিক মানুষের সভায় তিনি দিলেন তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ। জনগণকে সার্বিক আন্দোলন, অসহযোগ এবং যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বান জানালেন। বললেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ। এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’
১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত এই ভূখণ্ডে পাকিস্তান সরকারের কোনো আদেশ কার্যকর ছিল না। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই সবকিছু চলেছে। তখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একটি হাইকমান্ড তৈরি করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তিনজন সহসভাপতি (সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও খোন্দকার মোশতাক আহমদ), ঢাকায় অবস্থিত কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ এবং পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামানকে নিয়ে গঠিত হয় সেই হাইকমান্ড। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সার্বক্ষণিক কাজ করার জন্য তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে কামাল হোসেন ও আমি টাস্কফোর্স হিসেবে কাজ করি। বঙ্গবন্ধুর লাইব্রেরি রুমটিতে টেলিফোন ও একটি লেখার টেবিলে বসে আমি সার্বক্ষণিক কাজ করতাম। ৩ থেকে ২৫ মার্চ এই টাস্কফোর্স থেকেই সব নির্দেশনা তৈরি হতো এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ডি ফ্যাক্টো সরকার তখন থেকেই কাজ করছিল।
১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ থেকে ৩০ মার্চের মধ্যে পায়ে হেঁটে তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে আমার ভারতে প্রবেশ, এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সফল বৈঠক এবং ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন ও স্বাধীনতার অপরিহার্যতা বর্ণনা করে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রণয়ন—এসব ঘটনা আমাকে আজও রোমাঞ্চিত করে।
মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর নামে এবং বঙ্গবন্ধুকে হৃদয়ে ধারণ করে। একাত্তরে মুক্ত মুজিবের চেয়েও বন্দী মুজিব আরও অনেক বড় অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছিলেন। মুজিবনগর সরকারের বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা, সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত, ভারতের সরকার ও জনগণ এবং বিশ্বের প্রতিটি মুক্তিকামী মানুষের অকুণ্ঠ সাহায্য ও সমর্থনে মাত্র নয় মাসে স্বাধীন হলো বাংলাদেশ। বীর মুক্তিযোদ্ধারা একের পর এক সাহসী ও বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে মুক্ত করেছেন বাংলার প্রতিটি প্রান্তর। স্বাধীনতার জন্য, এ যুদ্ধে জেতার জন্য জনগণ এক অতুলনীয় ত্যাগ ও তিতিক্ষার উদাহরণ রেখেছে। ৩০ লাখ লোক শহীদ হয়েছেন। দুই লাখ মা-বোন হয়েছেন ইতিহাসের নজিরবিহীন ঘৃণ্য ও পাশবিক নির্যাতনের শিকার। এর বিনিময়ে আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা।
এক অজানা পথে
২৫ মার্চ ১৯৭১। একটি ভয়াল রাত। বাঙালির ঐক্যবদ্ধভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর একটি চরম মুহূর্ত। পাকিস্তানি বাহিনীর ছোড়া কামান ও বোমার আঘাতে ঢাকার আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠছিল। বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতায় ছিল সেই নির্দেশনা, ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়—তোমাদের কাছে অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।’ ওই রাতেই আমি ও তাজউদ্দীন সাহেব লালমাটিয়ায় পূর্ব বাংলা রেলওয়ের সাবেক চিফ ইঞ্জিনিয়ার গফুর সাহেবের বাড়িতে আশ্রয় নিই।
২৭ মার্চ আমরা ঢাকার সীমানা পার হয়ে যাই। মুক্তাঞ্চলে তাজউদ্দীন আহমদ ও আমি হেঁটে চলেছি বিরতিহীন। দেখেছি, মানুষের চোখে-মুখে ক্ষোভ, তবে অন্তরে প্রতিরোধের দৃঢ় মনোবল। এ যুদ্ধ যেন মানুষের দৃষ্টিকে বদলে দিয়েছিল এক অলৌকিক ছোঁয়ায়—আমরা সবাই এক স্থির গন্তব্যের দিকে ধাবমান। আমরা সম্বলহীন ছিলাম, কিন্তু অসহায়ত্বের কোনো বেদনা আমাদের সেদিন স্পর্শ করতে পারেনি। পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সবার মধ্যে ছিল সম্মিলিত ও সুতীব্র এক ঘৃণা এবং প্রত্যেকের চোখে-মুখে ছিল সুদৃঢ় প্রত্যয় ও বিশ্বাস—সব বাধা অতিক্রম করে সর্বশক্তি দিয়ে রুখে দাঁড়ানোর হিমালয়সম অটল সংকল্প।
মার্চ মাসের শুরু থেকেই অফিস-আদালত, হাট-বাজার, পুলিশ, প্রশাসন—সবকিছু আমাদের সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশে চলছে। সংগ্রাম পরিষদ অস্ত্র, গোলাবারুদসহ সবকিছু তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। ১ মার্চ ১৯৭১ থেকে কার্যত যে সরকার সফলভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার নির্দেশেই সবকিছু চলেছে। বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রতি আন্তরিক আনুগত্য ছিল স্বতঃস্ফূর্ত ও প্রশ্নের অতীত। ইতিমধ্যে আর্মড ফোর্সেস, পুলিশ, ইপিআর, আনসার বাহিনী বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে গঠিত সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে সব শ্রেণির মানুষ তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে যে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়েছিল, তাদের নেতৃত্বে স্থানীয়ভাবে কাজ করার অভ্যাসটি ৭ মার্চের পর থেকেই সংঘবদ্ধ প্রতিরোধে রূপ নিয়েছে। আমাদের যাত্রাপথে ঢাকা থেকে জিগাতলা, কেরানীগঞ্জ, দোহার হয়ে পদ্মার চরে, ফরিদপুর, কামারখালী, মাগুরা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা—সর্বত্র সবারই দাবি, বাংলাদেশ সরকার গঠন করো। পথে চলতে গ্রামগঞ্জে, হাটে-লোকালয়ে আমাদের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যেও একই মনোভাব। কোথাও এর কোনো ব্যত্যয় লক্ষ করিনি। সবার সঙ্গে আলোচনা করে আমরা এ উপলব্ধি ও সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলাম যে এই মুহূর্তে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিনিধিত্ব করতে সক্ষম একটি কার্যকর ও বৈধ সরকার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
ওই মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর একটা কথা বারবার মনে পড়ছিল। তিনি বলেছিলেন, আমি সব তৈরি করে রেখে যাব। ২৫ মার্চ পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অপারেশন সার্চলাইটের আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি অফিসারসহ সেনাবাহিনী, ইপিআর পুলিশ বিদ্রোহ করে। সঙ্গে যোগ দেয় আনসার, স্বেচ্ছাসেবক, যুবক, তরুণ রাজনৈতিক নেতা-কর্মী। ফলে ২৫ মার্চের রাতেই মুক্তিযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে। দৃশ্যত মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আর ঢাকার মানুষের চলাচল গণমিছিলের মতো গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে, ছড়িয়ে পড়ছে নিজ নিজ এলাকায়। নিজ দেশের মাটিতে, নিজ শহর ও রাজধানী থেকে বিতাড়িত হয়ে প্রতিটি মানুষ একেকটি বিস্ফোরণোন্মুখ আগ্নেয়গিরিতে পরিণত হচ্ছে। দেশের মাটিকে খাঁটি জেনে প্রাণপণ লড়াইয়ের মানসিক প্রস্তুতি তাদের চোখে-মুখে দৃপ্ত। কান্না নেই, হাহাকার নেই। প্রতিবাদ আর প্রত্যয়ে সুদৃঢ় মুখাবয়ব, প্রতিটি মানুষই একেকটি বিপ্লবের প্রতিচ্ছবি। বিভিন্ন সময়ে বঙ্গবন্ধুর নানা কথার, ৭ মার্চের ভাষণে প্রদত্ত স্বাধীনতার বার্তারই যেন প্রতিফলন দেখছি চারপাশে। নয় মাসের যুদ্ধের পুরো সময়েও আমরা সেটাই দেখেছি।
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা
বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ মার্চের বক্তৃতায় স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, ‘প্রত্যেক গ্রাম প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ। এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এর মাধ্যমে যা কিছু বলার সবই বলা হয়েছিল। বাংলাদেশের আবালবৃদ্ধবনিতা জানত, বাঙালির ওপর আক্রমণ করলে কী করতে হবে।
অসহযোগ আন্দোলনের সময় দেশের সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ বঙ্গবন্ধু ও হাইকমান্ডের নির্দেশে পরিচালিত হতো। তখন আমরা বিভিন্ন সরকারি, আধা সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতাম। পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে ব্যাংক লেনদেন থেকে শুরু করে সব যোগাযোগ ও আদান-প্রদান বন্ধ করে দেওয়া হয়। শুধু নির্দিষ্ট সময়ে সাংবাদিকদের খবর পাঠানোর জন্য টেলিযোগাযোগ চালু করা হতো। ব্যাংক, বিমা, চেম্বার, রেল, ব্যবসায়ী নেতারা, শ্রমিক সংগঠন থেকে সব স্তরের সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছি। তাদের সঙ্গে কিছু বৈঠক হতো মতিঝিলে, কিছু ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে আর কোনো কোনো বিশেষ বৈঠক বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের পাশে বেগম বদরুন্নেসা আহমেদের বাসায়। বেতার ও টেলিযোগাযোগের বিষয়গুলো নিয়ে ইঞ্জিনিয়ার নূরুল হকের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হতো বেগম বদরুন্নেসার বাসায়।
সম্ভবত ১৮ বা ১৯ মার্চ, ইঞ্জিনিয়ার নূরুল হক (খোকা ভাই) আমাকে বললেন, বঙ্গবন্ধু তাঁকে একটা ট্রান্সমিটার জোগাড় করতে বলেছিলেন। সেটা তিনি নিয়ে এনেছেন। এখন এটা কোথায় পৌঁছে দিতে হবে? তিনি আরও বললেন, ‘এ ট্রান্সমিটারটি পুরোনো। অনেক দিন থেকে খুলনাতে পড়ে ছিল। সবাই এটার কথা ভুলেই গেছে।’ অফিস রেজিস্ট্রিতেও এর হদিস ছিল না। তবে সেটি তিনি সারিয়ে সচল করে তুলেছেন।
নূরুল হক সে সময় ইস্টার্ন ওয়্যারলেস ডিভিশন অ্যান্ড ট্রান্সমিটিং স্টেশনের প্রধান। ২৫ মার্চ বেলা দুইটার দিকে আমি দুপুরের খাবার খেতে বাসায় গিয়েছি। গিয়ে দেখি, নূরুল হক সাহেব বাসায় ঢুকছেন। তিনি বললেন, আজকেই একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে। আমাকে তিনি খুব সাবধানে থাকতে বললেন। আরও বললেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না, আমার এখন করণীয় কী। এটা নিয়ে আমি এখন কী করব।’ তিনি আরও বললেন, ‘আজকের দিনটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মনে হচ্ছে, একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে।’
আমি খোকা ভাইকে বললাম, ‘বঙ্গবন্ধু বলে দিয়েছেন তোমাদের যার যা আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করবে।’ আমার কাছে কলম আছে, সংগঠন আছে। আমি এগুলো দিয়ে মোকাবিলা করব। আপনার কাছে ট্রান্সমিটার আছে, ইঞ্জিনিয়ারিং বুদ্ধি আছে, আপনি ওটা দিয়েই মোকাবিলা করবেন। আমি কি আপনাকে লিখে দেব ট্রান্সমিটারে কী বলতে হবে? উনি বললেন, তার প্রয়োজন হবে না। আমি জানি, কী বলতে হবে। একধরনের আত্মবিশ্বাসের ভঙ্গিতে অথচ নির্লিপ্তভাবে তিনি যেন নিজেকে নিজে শুনিয়ে বললেন, ‘আই নো হোয়াট ইজ টু বি ডান। ইট মে কস্ট মাই লাইফ, বাট ইট মে বি ওয়ার্থ ডুইং অ্যান্ড আই উইল ডু ইট।’
২৫ মার্চ মধ্যরাতে এক ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর বাসায় ফোন করেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ওই ব্যক্তি ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার নূরুল হক। হাজি গোলাম মোরশেদের সঙ্গে তাঁর কথা হয়। হাজি গোলাম মোরশেদ বললেন, আপনি কে? উনি পরিচয় না দিয়ে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে জানান যে আমি বলধা গার্ডেন থেকে বলছি। আমি মেসেজ পাঠিয়ে দিয়েছি। এখন মেশিন কী করব?’
বঙ্গবন্ধু তখন পাশেই ছিলেন। তিনি হাজি গোলাম মোরশেদকে বললেন, ‘তাঁকে বলো, কাজ শেষ করে মেশিন ভেঙে পালিয়ে যেতে।’ আমার বিশ্বাস, নূরুল হক খুলনা থেকে আনা ট্রান্সমিটারে এই রাতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার বার্তা পাঠিয়েছিলেন। ইঞ্জিনিয়ার নূরুল হক ব্রিটিশ আমলের ওয়্যারলেস ইঞ্জিনিয়ার। তিনি শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের মেধাবী ছাত্র ছিলেন। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর যত ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক—সবই তাঁর নিজের তৈরি। রানি এলিজাবেথ ১৯৬০-এর দশকে যখন ঢাকা আসেন, তাঁর জন্য তৈরি করা রমনা পার্কের সামনের বাড়িটি ছিল ১৯৭২ সালের প্রথম গণভবন। ওই ভবনে তিনি রানি এলিজাবেথের জন্য স্থাপন করে দেন একটি ওয়্যারলেস যোগাযোগ ব্যবস্থা। তার মাধ্যমে তিনি বাকিংহাম প্যালেসের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতেন।
পাকিস্তান সরকার নেপালকে ওয়্যারলেস সিস্টেম স্থাপনে সহায়তা করার জন্য ইঞ্জিনিয়ার নূরুল হককে সেখানে পাঠিয়েছিলেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে নেপালের আধুনিক ওয়্যারলেস ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিভা, দক্ষতা ও যোগ্যতার জন্য সে সময়ে সরকার তাঁকে ‘তমঘা-ই-পাকিস্তান’ উপাধিতে ভূষিত করে। মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের সময় তিনি সে খেতাব প্রত্যাখ্যান করেন। খবরের কাগজে এ খবর তখন ছাপা হয়েছিল। ২৫ মার্চের পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ট্রান্সমিটার খঁুজতে নূরুল হকের ওয়্যারলেস কলোনির বাসা ঘেরাও করে। ২৬ মার্চ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত পাকসেনারা তাঁকে নানা জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং নজরদারিতে রাখে। তাঁর বাড়িতে তল্লাশি চালায়। ২৯ মার্চ সকালে নূরুল হককে পাকসেনারা তাঁর বাসা থেকে নিয়ে যায়। তিনি আর ফিরে আসেননি।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ওয়্যারলেসে ইংরেজিতে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হয়। এ বিষয়ে লন্ডনের দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার সাংবাদিক ও দক্ষিণ এশিয়া করেসপন্ডেন্ট ডেভিড লোশাক লিখেছেন, ঘোষণাকারীর গলার আওয়াজ খুব ক্ষীণ ছিল। খুব সম্ভবত ঘোষণাটি আগেই রেকর্ড করা ছিল। উল্লেখ্য, ডেভিড লোশাক প্রথম বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বিষয়টি উল্লেখ করেছিলেন। উইটনেস টু সারেন্ডার বইয়ে কর্নেল সিদ্দিক সালিক লিখেছেন, এই ঘোষণাটি তাঁর ট্রান্সমিটারে ধরা পড়েছিল।
২৫ মার্চ রাতে জীবনের সব ঝুঁকি অবজ্ঞা করে হাজি গোলাম মোরশেদ ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে থেকে যান। বঙ্গবন্ধু আমাকে ও কামাল হোসেনকে যখন বিদায় দেন, হাজি গোলাম মোরশেদ তখনো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে আছেন। সেই রাতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তিনিও গ্রেপ্তার হন। সেখানে তাঁর ওপর চলে অমানুষিক নির্যাতন। নির্যাতনের সময় তাঁকে ‘মুজিব কা সেক্রেটারি, মুজিব কা ড্রাইভার’ বলে পেটানো হতো। দীর্ঘদিনের অমানবিক নির্যাতনের পর মুমূর্ষু অবস্থায় তিনি ২৫ নভেম্বর মুক্তিলাভ করেন।
২৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার খবর সব জেলা ও মহকুমা প্রশাসকদের কাছে পৌঁছে যায়। লিফলেট আকারে সেসব প্রচার করা হয়। আমি যখন তাজউদ্দীন ভাইকে নিয়ে চুয়াডাঙ্গা পৌঁছেছি, দেখি, সেখানে হাজার হাজার মানুষ যোদ্ধায় পরিণত হয়েছে। বুঝতে পারলাম, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা এখানেও পৌঁছে গেছে। তাজউদ্দীন আহমদসহ আমি যখন ভারতে প্রবেশ করি, তখন বিএসএফের কাছ থেকে আমরা জানতে পারি, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তা তাদের ওয়্যারলেসেও ধরা পড়েছে। তার একটা কপি আমাকেও দেওয়া হলো। দিল্লিতে যখন চট্টগ্রামের এম আর সিদ্দিকের সঙ্গে দেখা হয়, তাঁকে ওই কপিটা দেখাই। তিনি বললেন, চট্টগ্রামে তাঁরা এ ঘোষণাটাই পেয়েছেন। প্রত্যেক সীমান্তে এই বার্তাটি পাঠানো হয়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ইঞ্জিনিয়ার নূরুল হক সাহেব এ কাজটি করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তা ওয়্যারলেস ট্রান্সমিটারসহ নানাভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল।
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার ভিত্তিতেই পরে আমরা প্রস্তুত করেছিলাম স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। তাতে বলা হয়, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন...।’ বাঙালি জাতির পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করার একমাত্র অধিকার ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। তিনিই ছিলেন বাঙালি জাতির বৈধ প্রতিনিধিদের দেওয়া অর্পিত ক্ষমতার অধিকারী। তাঁর পক্ষে জনগণের নিরঙ্কুশ ম্যান্ডেট ছিল। কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ওই ঘোষণাটিই প্রথম পাঠ করেন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল হান্নান এবং পরবর্তীকালে মেজর জিয়াউর রহমান।
২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণার মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় এ সরকার শপথ নেয়। অথচ কেউ কেউ বলেন, আওয়ামী লীগের কোনো যুদ্ধপ্রস্তুতি ছিল না। ৪ এপ্রিল সিলেটের তেলিয়াপাড়ায় কর্নেল (অব.) এম এ জি ওসমানীর নেতৃত্বে বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন মেজর খালেদ মোশাররফ ও মেজর জিয়াউর রহমানসহ মুক্তিকামী বহু সেনা কর্মকর্তা। সে সভা থেকে একটি সরকার গঠনের জন্য আমাদের কাছে খবর পাঠানো হয়। ১০ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর প্রথম বেতার ভাষণে বলেন, ‘পাহাড়প্রমাণ লাশের নিচে পাকিস্তানের কবর রচিত হয়েছে। জেগে উঠেছে একটি নতুন জাতি।’
ভারতে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিনিধি
৩০ মার্চ বেলা তিনটার দিকে চুয়াডাঙ্গা থেকে আমি ও তাজউদ্দীন ভাই সীমান্তের পথে রওনা হই। প্রথমে আমরা ভারতীয় সীমান্তের বর্ডার আউটপোস্টের (বিওপি) দিকে যাই। সীমান্ত অতিক্রম করার সময় সহকারী হিসেবে আমাদের সঙ্গে ছিলেন মেহেরপুরের তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী ও ঝিনাইদহের এসডিপিও মাহবুব উদ্দিন। তাঁদের বললাম, আপনারা চেকপোস্টে গিয়ে এ কথাগুলো বলবেন, প্রয়োজনে বারবার বলবেন: ‘স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপর্যায়ের দুজন নেতা ভারত সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনার জন্য ভারতে প্রবেশ করতে চান। ভারত সরকার রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় আমন্ত্রণ জানালে তারা ভারতে প্রবেশ করতে রাজি আছেন।’
তৌফিক-ই-এলাহী ও মাহবুব বার্তাটি নিয়ে চলে গেলেন ভারতীয় সীমান্ত ফাঁড়িতে। বার্তাটি ছিল খুবই সুচিন্তিত। আমরা জানতাম, ভারতীয় চেকপোস্টে কর্তব্যরত কর্মকর্তা এ বার্তার উত্তর দিতে পারবেন না। কলকাতায় অবস্থিত বিএসএফের ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান, এমনকি দিল্লির কমান্ডার ইন চিফও এ বার্তার উত্তর দিতে পারবেন না। এ বার্তার উত্তর দিতে পারবেন একমাত্র ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর উত্তর পেলেই আমরা যাব।
কিছু দূরে একটি জঙ্গলের মধ্যে ছোট্ট খালের ওপর ব্রিটিশ আমলের তৈরি একটি কালভার্ট। কালভার্টের ওপর তাজউদ্দীন ভাই ও আমি বসে আছি। তাজউদ্দীন ভাইকে ক্লান্ত ও বিষণ্ন মনে হলো। তাঁকে বিষণ্নতার কারণ জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, ‘আমি হেরে যাচ্ছি।’
আমি বললাম, ‘আমরা এখন বিজয়ের পথে এগোচ্ছি। নতুন একটি রাষ্ট্রের জন্ম হতে চলেছে। এ মুহূর্তে হেরে যাওয়ার কথা তো খুবই বেমানান। যে সূর্যটি অস্ত যাচ্ছে, এ অস্তগামী সূর্যের সঙ্গে আমাদের পরাধীন যুগেরও সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে। শিগগিরই স্বাধীনতার নতুন সূর্য উঠবে। এমন একটি প্রত্যাশার দুর্লভ মুহূর্তে আপনি বলছেন আপনি হেরে যাচ্ছেন? আমি এ কথার অর্থ বুঝতে পারছি না।’
তিনি বললেন, ‘ছোটবেলায় স্কুলের হিন্দু সহপাঠীরা বলত, তোদের পাকিস্তান টিকবে না। আমি পাল্টা যুক্তি ও নানা উদাহরণ দিয়ে বলতাম, পাকিস্তান অবশ্যই টিকবে। নানা তথ্য ও যুক্তি তুলে ধরে প্রমাণ করতাম যে পাকিস্তান একটা টেকসই রাষ্ট্র হবে। সেসব যুক্তি-তর্কে আমি জিতে যেতাম। সেই আমি আজ হেরে যাচ্ছি।’ ছোটবেলার সহপাঠীদের কথা তাঁর মনে পড়ছে। বাংলাদেশের আকাশে সূর্য ডুবুডুবু। আবার কখন নতুন সূর্যের উদয় হবে, তা ভাবতে ভাবতে আমরা দুজনেই মৌন। ক্লান্তিতে কালভার্টের ওপর শরীর এলিয়ে দিলাম। জঙ্গলের ভেতরে অন্ধকার গাঢ় হয়ে এসেছে। চারদিকে কোনো জনবসতি নেই বললেই চলে।
বেশ অনেকটা সময় পরে আবছা অন্ধকারে মানুষের পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। তাজউদ্দীন ভাইকে ডেকে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম। শব্দটা ক্রমে আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। আগন্তুকেরা কাছে এসেই হাতের অস্ত্র উঁচু করে সামরিক কায়দায় আমাদের অভিবাদন জানালেন। কর্মকর্তাটি বললেন, ‘স্যার, ইউ আর কর্ডিয়ালি ইনভাইটেড টু ভিজিট আওয়ার ক্যাম্প।’ বিদেশি রাষ্ট্রের সম্মানিত অতিথিদের যেভাবে গার্ড অব অনার দিয়ে নিয়ে যায়, আমাদেরও ঠিক সেভাবে আমন্ত্রণ জানানো হলো। পরে জেনেছি, বিএসএফের বিওপি থেকে তৎক্ষণাৎ বার্তা পাঠানো হয়েছিল বিএসএফের ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান গোলক মজুমদারের কাছে। তিনি বিএসএফের সর্বভারতীয় প্রধান দিল্লিতে অবস্থিত কে এফ রুস্তমজির সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
বিএসএফের ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান আমাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য রওনা হয়ে গেছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিএসএফের আঞ্চলিক প্রধান গোলক মজুমদার ছাউনিতে এসে পৌঁছালেন। তিনি জানালেন, হাইকমান্ডের নির্দেশেই তিনি এখানে এসেছেন। মজুমদার বললেন, ‘আপনাদের প্রশ্নের জবাব শুধু একজনই দিতে পারেন; তিনি প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী।’ আমাদের আশ্বস্ত করে তিনি বললেন, তাঁরা আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করে দেবেন। তিনি তাঁর সঙ্গে আমাদের কলকাতা যেতে অনুরোধ করলেন। বললেন, তাঁর পক্ষে এখন কিছু ছোট অস্ত্রশস্ত্র দেওয়া সম্ভব। প্রতীকী অর্থে সহায়তার জন্য কিছু অস্ত্রও তিনি দিলেন। মাহবুব ও তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীকে সেসব দেওয়া হলো। তিনি বললেন, ‘এখানে আসার আগে আমি দিল্লিতে যোগাযোগ করেছিলাম। আজ রাতেই আপনাদের অভ্যর্থনা জানাতে সেখান থেকে একজন আসছেন।’ তৌফিক-ই-এলাহী ও মাহবুবকে বিদায় জানিয়ে মজুমদারের জিপে করে তাজউদ্দীন ভাই ও আমি কলকাতার উদ্দেশে যাত্রা করলাম।
জিপটা এসে দমদম এয়ারপোর্টের টারমাকে থামল। মজুমদার জানালেন, আমাদের সঙ্গে আলোচনার উদ্দেশ্যে এই ফ্লাইটে দিল্লি থেকে একজন কর্মকর্তা আসবেন। দমদম এয়ারপোর্টে জিপ থেকে নামিয়ে আমাদের অপেক্ষাকৃত বড় কালো রঙের একটি গাড়িতে তোলা হলো। বিমান থেকে ছয় ফুট লম্বা একজন লোক নেমে সোজা আমাদের গাড়িতে এসে উঠলেন। তিনি বিএসএফের সর্বভারতীয় প্রধান কে এফ রুস্তমজি। একসময় ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নেহরুর নিরাপত্তাপ্রধান ছিলেন। সে কারণে নেহরু পরিবার ও ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা। প্রধানমন্ত্রীর তিনি খুবই আস্থাভাজন। পরে জেনেছি, রুস্তমজি গোলক মজুমদারের বার্তা পাওয়ার পর কোনো প্রোটোকল না মেনে সরাসরি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে বলেছিলেন, ‘আপনি নিজে গিয়ে তাঁদের অভ্যর্থনা জানাবেন। তাঁদের দেখে আপনার কাছে খুব “ইমপ্রেসিভ” মনে নাও হতে পারে। বাঙালিরা অত্যন্ত আত্মসচেতন ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানুষ। তাঁদের সঙ্গে আমাদের ব্যবহার যেন উপযোগী হয়।’
গাড়িতেই শুরু হলো আলোচনা। রুস্তমজির প্রথম প্রশ্ন, বঙ্গবন্ধু কোথায়? এটা গোলক মজুমদারেরও প্রথম প্রশ্ন ছিল। এরপর আরও অনেকের সঙ্গে দেখা হয়েছে। সবারই প্রথম প্রশ্নই ছিল, বঙ্গবন্ধু কেমন আছেন? এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমরা তৈরি ছিলাম। মুক্তিযোদ্ধাসহ দলীয় নেতারা সবার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর অবস্থানের ব্যাপারে একটি উত্তরই আমরা দিয়েছি। আমরা বলতে চেয়েছি, বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী যুদ্ধ পরিচালনা করা হচ্ছে। তিনি জানেন, আমরা কোথায় আছি। তিনি আমাদের দায়িত্ব ভাগ করে দিয়েছেন।
রাতে রাষ্ট্রীয় অতিথিশালা ‘অসম ভবনে’ আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হলো। একটি ঘরে আমি আর তাজউদ্দীন ভাই, অন্য ঘরে রুস্তমজি। আমরা খুবই ক্লান্ত। আমাদের কাপড়চোপড়ের অবস্থাও একেবারে শোচনীয়। গোসল করা প্রয়োজন। সঙ্গে অতিরিক্ত কোনো কাপড় নেই। রুস্তমজি আমার পরিধেয় বস্ত্রের অভাবের কথা জেনে তাঁর ইস্তিরি করা পায়জামা আর কোর্তা দিলেন। ছয় ফুট লম্বা একজন মানুষের কোর্তা সামাল দেওয়া আমার পক্ষে কষ্টকর হয়ে দাঁড়াল। দেখলাম, পায়জামার দরকার নেই, শুধু কোর্তা হলেই চলে। কে এফ রুস্তমজি তাঁর লেখা দ্য ব্রিটিশ, দ্য ব্যান্ডিটস অ্যান্ড দ্য বর্ডারম্যান বইয়ে এসবের চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন।
তখন প্রায় মধ্যরাত। গোসল সেরে নিলাম। এত রাতে খাবার পাওয়া কষ্টকর। রুস্তমজি ফৌজি প্রশিক্ষণের অভ্যাস হিসেবে সব সময় নিজের সঙ্গে ভাঁজ করা একটা স্টোভ রাখতেন। ইচ্ছে করলেই সেটা দিয়ে রুটি টোস্ট বা ডিম সেদ্ধ করা যায়। তিনি কয়েকটা রুটি টোস্ট ও ডিম সেদ্ধ করে দিলেন। সঙ্গে গরম চা। সারাটা দিনের পর অত্যন্ত তৃপ্তির সঙ্গে আমাদের আহার হলো। খাওয়ার পর টেবিলের ওপর রাখা একটি মানচিত্রের দিকে আমরা চোখ রাখলাম। কোনো দিন যুদ্ধ করিনি বা যুদ্ধের কথা ভাবিনি। অথচ আজ যুদ্ধের পরিকল্পনায় অংশ নিতে হচ্ছে। রুস্তমজি রণকৌশলী। আমাদের মূল উদ্দেশ্য তাঁকে সংক্ষেপে জানালাম। আজ রাতেই আমাদের অনেকগুলো সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সেই রাতেই পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ প্রধান ও বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের সেখানে আনা হলো। তাঁদের সঙ্গে বৈঠক হলো আমাদের। তাজউদ্দীন আহমদ বিস্তারিতভাবে আমাদের আন্দোলন থেকে শুরু করে সব পরিস্থিতির বর্ণনা দিলেন। সেনানিবাস ছাড়া সবই আমাদের মুক্ত এলাকা। আমরা কী পরিস্থিতিতে এখানে এসেছি, তা-ও সবাইকে বুঝিয়ে বললেন। আমাদের প্রথম কাজ হলো দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা রাজনৈতিক নেতা ও নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের একত্র করে পরামর্শের জন্য তাদের সীমান্তের কাছে নিয়ে আসা। সামরিক বাহিনী, রাইফেলস, আর্মড পুলিশ ও সিভিল প্রশাসনের সদস্যদের সঙ্গেও যোগাযোগ ও সহযোগিতা গড়ে তোলা দরকার। বিএসএফের বিভিন্ন বিভাগের প্রধানদের এই গভীর রাতে ডেকে আনা হলো। কলকাতা থেকে চুয়াডাঙ্গা টেলিযোগাযোগ এবং দর্শনা পর্যন্ত রেল যোগাযোগ স্থাপন করার আদেশ হলো। চুয়াডাঙ্গায় ডা. আসহাবুল হক তৌফিক ও নূরুল কাদেরের সঙ্গে আলোচনা হলো পরদিন সকালেই। নূরুল কাদের খান পাবনা থেকে কুমারখালী হয়ে সেখান থেকে চুয়াডাঙ্গা এসে পৌঁছেছেন। উভয়েরই দাবি অস্ত্র ও গোলাবারুদের। ট্যাংক নিয়ে এলে যশোর ক্যান্টনমেন্ট আমরা দখল করে নিতে পারি ইত্যাদি। আমরা অবশ্য জানি, যুদ্ধ আন্তর্জাতিকীকরণ হলে স্বাধীনতার সম্ভাবনা সুদূর পরাহত হবে।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, সম্পাদক, এমএনএ, এমপিএসহ নেতাদের একটি তালিকা তৈরি করে তাঁদের সম্ভাব্য অবস্থানের কথা লিপিবদ্ধ করা হলো। এসব নেতার সঙ্গে যোগাযোগের জন্য তালিকাটি পাঠানো হলো বিভিন্ন সীমান্ত ফাঁড়িতে। যশোর সেনানিবাস অবরুদ্ধ। কুষ্টিয়ায় আমরা জয়লাভ করেছি।

https://www.englishgrammarsite.com/2020/08/effective-sentence.html
https://www.englishgrammarsite.com/2022/03/all-about-completing-sentences.html
https://www.englishgrammarsite.com/2020/12/rules-of-changing-voice-active-to-passive.html
https://www.bcspedia.com/2022/03/for-those-44th-bcs-is-1st-bcs.html

https://www.bcspedia.com/2022/03/gaza-strip-and-west-bank-of-palestine.html

🅻🅰🅱🅴🅻🆂


বাংলাদেশ বিষয়াবলি

বাংলা ভাষা সাহিত্য

গাণিতিক যুক্তি

ইংরেজি ভাষা সাহিত্য

ভাইভা বোর্ড

বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্ন সমাধান

পরামর্শ V. V. V. I.

ভূগোল (বাংলাদেশ বিশ্ব) পরিবেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা

সাধারণ বিজ্ঞান

হ্যান্ডনোট এবং তথ্যবহুল চিত্র

আন্তর্জাতিক

জাতীয়

পরামর্শ

পাঁচমিশালী তথ্য + সাধারণ জ্ঞান

বাংলা ব্যাকরণ

সাধারণ জ্ঞান

বাংলা সাহিত্য

বিসিএস পরামর্শ

কম্পিউটার তথ্যপ্রযুক্তি

নৈতিকতা মূল্যবোধ সুশাসন

English Grammar

গুরুত্বপূর্ণ শব্দ পরিচিতি

বিগত পরীক্ষাসমূহ

মডেলটেস্ট

মানসিক দক্ষতা

Vocabulary

অনুপ্রেরণা

ফাঁদ প্রশ্ন

বানান শুদ্ধিকরণ

মুক্তিযুদ্ধ

সংবিধান

সাধারণ বিজ্ঞান

ICT

One Word Substitution

Redundancy বাহুল্য (দোষ)

Spoken English

আইনকানুন

আন্তর্জাতিক বিষয়: সীমারেখা

আপডেট

আপডেট তথ্য

আবিষ্কার আবিষ্কারক

আলোচিত ১১ জন কবি-সাহিত্যিক তাঁদের রচনাবলী

ইংরেজি

ইংরেজি সাহিত্য

উপাধি ছদ্মনাম

এটর্নি জেনারেল

কম্পিউটার তথ্য প্রযুক্তি

গণিত

গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন

চর্যাপদের কবিগণ

জ্ঞান-বিজ্ঞানের শাখা এবং জনক

জ্যামিতিক সূত্র

দেশী বিজ্ঞানীরা

নদ-নদী

পত্রিকা এবং ছদ্মনাম

পরিবেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা

পরিমিতির (Mensuration) সূত্রাবলিসমূহ

পারিভাষিক শব্দ

পুরাতন নতুন নাম

ফলা এবং যুক্তাক্ষর

ফ্রান্সের ইসলাম-বিদ্বেষ

বাংলা

বাংলা ইংরেজি সাহিত্যের মিলবন্ধন

বাংলা ভাষা সাহিত্য

বাংলাদেশ বিশ্বপরিচয়

বাগধারা

ভাষা আন্দোলন

ভূগোল

ভৌগোলিক উপনাম

মডেল টেস্ট

মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক সাহিত্যকর্ম

লিখিত পরীক্ষা

লেখা লেখক

শ্রেষ্ঠ বাঙালি

সংবিধান সংশোধনী

সদর-দপ্তর

সভ্যতা

সমাস

সাজেশন

সাম্প্রতিক

সাহিত্য-উৎসর্গ

সাহিত্যে কনফিউশন

স্থাপত্য স্থপতি

স্পোকেন ইংলিশ

. আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি

৪০০টি প্রশ্নোত্তর: কম্পিউটার এবং কম্পিউটার-প্রযুক্তি

৫২ থেকে ৭১

মার্চ