বিসিএস লিখিত প্রস্তুতি
আন্তর্জাতিক
ইরান - আমেরিকা সংকট
লিখেছেন > Himaloy Him
কেন এই বৈরিতাঃ
১৯৫৩ সালে তৎকালীন ইরানের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মাদ মোসাদ্দেক তেল সম্পদকে জাতীয় করন করতে চেয়েছিলেন। ইরানের তেল সম্পদের এক বিরাট অংশ ব্রিটিশরা নিয়ন্ত্রন করত। ইরানের এই জাতীয় সম্পদ ইরানের অর্থনৈতিক অবস্থায় কোন পরিবর্তন আনতে পারছিল না কারণ এর সিংহভাগ সুবিধা পেত ব্রিটিশরা। তাই এই সম্পদ জাতীয় করনে বাঁধা দিতে আমেরিকা-ব্রিটেন এর গোয়েন্দারা অভ্যুত্থানের চেষ্টা করল । এর ফলে সরকার থেকে প্রধানমন্ত্রীকে সরে যেতে হয় । এরপর আমেরিকার মদদপুষ্ট রেজা শাহ ক্ষমতায় আসে। তারপর এই সরকার গোপন সাভাক পুলিশ বাহিনী দিয়ে তার বিরোধীদের উপর দমন-পীড়ন নীতি চালায়। তখন খোমেনি প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে রেজা শাহের বিরোধিতা করেন। কিন্তু সরকারের চাপে তাকে প্যারিসে নির্বাসনে যেতে হয়। ঘটনার পরিক্রমায় ১৯৭৯ সালে ইরানে রেজা শাহের বিরুদ্ধে ইরানিরা বিপ্লব করে । সমস্ত ইরানিরা এতে অংশগ্রহণ করে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে। ইতিহাসে এ বিপ্লব ইসালামিক বিপ্লব নামে পরিচিত। তখন খোমেনি দেশে ফিরে আসেন এবং দেশের মানুষ তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায়। দেশকে ইসালমি প্রজাতন্ত্রে পরিনত করেন এবং তিনি সুপ্রিম লিডার হিসেবে নিজেকে নিয়োগ করেন ।। ওপরদিকে রেজা শাহ কে নির্বাসনে যেতে হয়। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের আশ্রয়ে যান চিকিৎসা করার জন্য। এতে ইরানিরা আরো ক্ষুব্ধ হন। খোমেনির এই বিজয় পাশ্চাত্যে অপমানের তীর হয়ে বিধে। তারা খোমেনির বিরোধিতা শুরু করে, বিভিন্নভাবে কোণঠাসা করতে চায়।
আমেরিকা বিরোধী ইরানের কার্যক্রমঃ
১। আমেরিকার প্রতি বিদ্বেষ তখন ইরানে তুঙ্গে । তখন ইরানের মার্কিন দূতাবাসে ইরানের ছাত্ররা হামলা করে। ৫২ জনকে ৪৪৪ দিনের জন্য জিম্মি করে রাখে যা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ছিল সবচেয়ে বড় আঘাত। এ থেকে ইরান-যুক্ত্রাষ্ট্র সম্পর্ক আরো খারাপের দিকে যায়।
২। ইরান আমেরিকা ও ইসরাইলেকে তাদের প্রধান শত্রু হিসেবে ইংগিত প্রধান করে।
৩। হরমুজ প্রণালীতে মার্কিন ড্রোন কে ভূপাতিত করে ইরান । ইরানের রেভ্যুলিউশনারি গার্ডসের প্রধান বলেছেন, মার্কিন ড্রোন ফেলে দিয়ে তারা যুক্তরাষ্ট্রকে খুব স্পষ্ট একটি বার্তা দিতে চেয়েছেন।সেটি হলো: ইরান যুদ্ধ চায় না, কিন্তু দরকার হলে যুদ্ধের জন্য তারা প্রস্তুত।
আমেরিকার কার্যক্রমঃ
সেই থেকে আমেরিকা প্রথম ইরানের উপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে।
১। ১৯৮০ সালে ইরান--ইরাক যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ইরাককে কৌশলগতভাবে বিভিন্ন সাহায্য করে। এই যুদ্ধে প্রায় ১০ লাখ মানুষ মারা যায়। ১৯৮৮ সালে খোমেনি যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হন।
২.১৯৮৮ সালে ৩ ই জুলাই একটি ইরানি যাত্রীবাহী বিমান যুক্তরাষ্ট্র ভূপাতিত করে। এতে সম্পর্কের বিষবাষ্পে আরো ঘি ঢেলে দেয়।
৩। ২০০২ সালে বুশ ইরান কে শয়তানের অক্ষশক্তির(ইরাক,ইরান,উত্তর কোরিয়া) একজন মনে করে।
৪। ইরানের রেভ্যুলেশানারি বাহিনীকে ট্রাম্প সন্ত্রাসী বাহিনী বলে আখ্যায়িত করে যা ইরানের জন্য অপমানজনক।
৫। ২০১৯ সালের জুন মাসে উপসাগরে ব্রিটিশ ট্যাংকারে হামলার জন্য ইরান কে দায়ী করা হয়।যদিও ইরান তা জোরালোভাবে প্রত্যখান করে।
ইরানের পরমাণু কর্মসূচি
রেজা শাহের শাসনামালে যুক্তরাষ্ট্র এর সহযোগিতায় ইরান পারমানবিক কর্মসূচি শুরু করে। এই কর্মসুচির নাম ছিল ‘এটমিক ফর পিস প্রোগ্রাম’ । ১৯৭৪ সালে রেজা শাহ এটমিক অরগানাইজেশন ফর ইরান প্রতিষ্ঠা করেন। তখন ২০ বছরে ২৩ টি পারমানবিক চুল্লি স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু ১৯৭৯ সালে ইরানে রাজনৈতিক ক্ষমতায় বিশাল একটা পরিবর্তন সাধিত হয় যা রেজা শা কে ক্ষমতাচ্যুত করে। যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা এ সময় স্থবির হয়ে যায়। তখন ইরান তা র ব্যাক্তিগত চেষ্টা অব্যাহত রাখে। ১৯৮৭-৮৮ সালের দিকে তাদের মিত্র আর্জেন্টিনার সাথে ৩ টি পারমানবিক চুক্তি সম্পাদন করে ইরান। ইরান-ইরাক যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র, ইরাকের পক্ষাবলম্বন করায় মস্কো-তেহরান সম্পর্কের ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়। তারা যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতিতে ইরান কে পারমানবিক কর্মসুচি বাস্তবায়নে সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করে। এতে ইরানের সামনে পারমানবিক যুগের এক নতুন দুয়ার উন্মোচিত হয়। ইরানে গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কাজ চলছে-১৯৯২ সালে মিডিয়ায় এমন অভিযোগে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) প্রতিনিধিদের পরমাণু কর্মসূচি পরিদর্শনের আহ্বান জানায় ইরান। পরিদর্শন শেষে প্রতিনিধিদলটি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে শান্তিপূর্ণ বলে। ১৯৯৫ সালে ইরান রাশিয়ার সঙ্গে ইরানের ‘বুশেহর’ প্ল্যান্টকে এগিয়ে নিতে চুক্তি করে। এরপর ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদ ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি জোরালোভাবে শুরু করেন।
পি৫+১ চুক্তি
যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে চেপে ধরার জন্য সর্বশেষ পরমানু শক্তির উপর তাদের নজর পরে । এই পরমানু কর্মসূচির জন্য আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর নিষাধাজ্ঞার চাপে পরে ইরান । এতে করে ইরানের তেল রপ্তানি ও অর্থনীতি ব্যাপক হুমকির মুখে পরে যায়। অর্থনৈতিক অবরোধ থেকে বের হয়ে আসার জন্য ইরান তাদের পরমানু কর্মসূচির অনেকটা ছোট করে ফেলার আশ্বাস দেয় । এই জন্যে ২০১৫ সালে নিরাপত্তা পরিষদের ৫ স্থায়ী সদস্য+ জার্মানিকে (পি৫+১) নিয়ে ইরান পারমানবিক চুক্তি করে ।
তবে ২০১৫ সালের চুক্তির পর ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্রক্রিয়া থেকে সরে আসে ইরান। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ইরান সংবেদনশীল পরমাণু কর্মকাণ্ড সীমিত করতে রাজি হয় এবং দেশটির বিরুদ্ধে আনা অর্থনৈতিক অবরোধ তুলে নেবার শর্তে আন্তর্জাতিক পরিদর্শকদের পরমাণু কর্মকাণ্ড পরিদর্শনে অনুমতি দেয়।
জাতিসংঘের পরমাণু বিষয়ক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি বা আইএইএ'র পরিদর্শকরা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা এবং সামরিক প্রকল্পগুলো পরিদর্শন করতে পারবেন- সে ব্যাপারে সম্মতি দেয় তেহরান।
নানতাজ এবং ফোর্ডো- ইরানের এই দুটি জায়গায় গড়ে ওঠা পারামণবিক কেন্দ্রে জড়ো করা হয়েছিল প্রচুর পরিমাণে ইউরেনিয়ামের বিশেষ আইসোটোপ ইউ-২৩৫। যা কিনা অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহার করা যায়। ১৫ বছর পর্যন্ত পরমাণু জ্বালানি রাখার পরিমাণ, সেন্ট্রি-ফিউজসহ অন্যান্য যন্ত্রাংশের উন্নয়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে সীমারেখা টেনে দেয়া হয়। শর্ত থাকে ইরান সেন্ট্রি-ফিউজ দুই-তৃতীয়াংশ হ্রাস করবে।
বর্তমানে ইরানের কাছে যে ইউরেনিয়াম আছে তা থেকে ৯৮ শতাংশ কমিয়ে ৩শ কেজিতে নামিয়ে আনতে হবে। ফোর্ডো কেন্দ্রের ভূ-গর্ভস্থ অংশকে বানাতে হবে পদার্থ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র। সেখানে কেবলমাত্র চিকিৎসা, কৃষি ও বিজ্ঞান গবেষণায় ব্যবহৃত রেডিও আইসোটোপ তৈরি করা যাবে।
চুক্তি অনুযায়ী ইরান সম্মত হয় যে তারা অস্ত্র তৈরিতে সক্ষম ইউরেনিয়াম উৎপাদন বন্ধ রাখবে।
আর ইরানের এসব শর্ত মেনে নেয়ার বিনিময়ে দেশটির বিরুদ্ধে আরোপ করা বিভিন্ন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেয়া হয় । দেশটি আবারো ফিরে পায় আন্তর্জাতিক বাজারে তেল বিক্রি এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের সুযোগ।
শর্ত অনুযায়ী, ২০৩১ সালের মধ্যে ইরান যদি চুক্তির কোনও শর্ত লঙ্ঘন করে তাহলে একটি যৌথ কমিশন গঠিত হবে। কমিশন যদি সমাধান করতে ব্যর্থ হয় তাহলে বিষয়টি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে উঠবে।
কিন্তু ২০১৮ সালে ট্রাম্প প্রশাসন এই চুক্তি থেকে ইরানের বিরুদ্ধে এক তরফা দাবি করে বের হয়ে যায় । ইরানর ওপর আরও চাপ বাড়ায় যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি ইরানের কাছ থেকে যারা তেল ক্রয় করে তাদেরকেও নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনার পদক্ষেপ নেয় তারা।
পরে উপসাগরে তেলের ট্যাংকারে কয়েকটি হামলার ঘটনাও ঘটে।
এরপর ইরানি কর্মকর্তারা তাদের ইউরেনিয়াম মজুদের সীমা বাড়ানোর কথা ঘোষণা করে।
ইরান আক্রমনের তৎপরতা নিয়ে বিশ্ব শক্তির মতামত
রাশিয়া
মধ্যপ্রাচ্যে অতিরিক্ত সৈন্য মোতায়েন করে যুদ্ধের 'উস্কানি' না দেওয়ার জন্য আমেরিকাকে আহ্বান জানিয়েছে রাশিয়া।
"আমরা বেশ কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছি যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক এবং সেই সাথে সামরিক চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রেখেছে, " বলেন রুশ ডেপুটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই রিবকভ।
"অস্থিতিশীল এই অঞ্চলে এ ধরনের অবিবেচনা-প্রসূত কাজ থেকে বিরত থাকতে আমরা তাদের (যুক্তরাষ্ট্র) এবং ঐ অঞ্চলে তাদের মিত্রদের বারবার সাবধান করেছি।"
চীন
চীনও উপসাগরে সংযত আচরণের জন্য ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন," অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টির যে কৌশল, যুক্তরাষ্ট্রের উচিৎ তা পরিহার করা। একতরফা আচরণ আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। এতে কোনো সমস্যার সমাধান তো হয়ইনা, বরঞ্চ আরো বড় সমস্যা তৈরি করে।"
এই উত্তেজনার প্রশমনে কি কি ভূমিকা রাখা যেতে পারেঃ
১। যুক্তরাষ্ট্র পি ফাইভ+ওয়ান চুক্তিতে থেকে ইরানের সাথে সমঝোতা এই সংকট নিরসন করতে পারে।
২। জাতিসংঘ মধ্যপ্রাচ্যের এই উত্তেজনা প্রশমনে পশ্চিমা স্বার্থের পাশাপাশি ইরানের স্বার্থ বজায় রেখে একটি শান্তিপূর্ন চুক্তি করতে পারে।
সম্ভাব্য প্রশ্ন
ইরান- যুক্তরাষ্ট্রের সংকটের কারণ লিখুন
ইরানের পারমানবিক কর্মসূচি সম্পর্কে ধারনা দিন
#৪০_রিটেন
তথ্যঃ বিভিন্ন বই, অনলাইন সাইট, বিবিসি ইত্যাদি ।