পুঁজি, প্রযুক্তি ও সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী একটি রাষ্ট্র অপেক্ষাকৃত দূর্বল একটি রাষ্ট্রর উপর যে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে নিয়ন্ত্রণ আরোপকারী দেশটিকে সাম্রাজ্যবাদী দেশ হিসেবে অভিহিত করা হয়। যে দেশের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয় তা হলো তার উপনিবেশ। সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও উপনিবেশিকরণ ইত্যাদি শব্দের ভিন্ন ভিন্ন অর্থ-থাকলেও শব্দগুলো একে অপরের পরিপূরক।
.
ভৌগোলিক আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যবাদের শুরু। পঞ্চদশ শতাব্দীর পূর্বে পৃথিবীর বিশাল অংশ মানুষের কাছে ছিল অজানা। শুধু এ অজানাকে জানা, অচেনাকে চেনা-মানুষের এ ধরনের কৌতুহল নিবারণের জন্যই পৃথিবীর অন্যত্র অবস্থিত ভূ-খণ্ড আবিষ্কারের জন্য কেউ বের হননি-এটি ছিল উঠতি বণিক গোষ্ঠীর বৈষয়িক সমৃদ্ধি ঘটানোর লক্ষ্যে অন্য দেশের সম্পদ আহরণের মাধ্যমে পুঁজির সঞ্চয়ন ঘটানোর প্রাথমিক প্রক্রিয়া। ভৌগোলিক আবিষ্কার ইউরোপের সম্মুখে সেই সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছিল। তবে ইউরোপকে সেই আবিষ্কারের জন্য অনেক কিছু অর্জন করতে হয়েছিল। পূর্ববর্তী অনেক আবিষ্কারকে কাজে লাগিয়ে ইউরোপের ভৌগোলিক আবিষ্কারকে সম্ভব করেছিল।
.
রেনেসাঁর উদ্ভব ইতালিতে হলেও এর বিস্তার ইউরোপের প্রায় সব দেশেই ঘটেছিল। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে ছাত্ররা ইতালির শহরগুলোতে শিক্ষালাভের জন্য আসতে থাকে এবং শিক্ষা গ্রহণ করে নিজ নিজ দেশে ফিরে গিয়ে শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এ রেনেসাঁই ইউরোপের মানুষের মনোজগতের পরিবর্তন আনয়ন করে। তার ফলে জ্ঞান-বিজ্ঞানে আত্মনিয়োগ করা, নতুন নতুন দেশ ও জাতির সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠা করার আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। আর সে কারণেই সমুদ্র পথে নতুন দেশের সন্ধান করার স্পৃহা মানুষের বাড়তে থাকে।
.
একাদশ শতাব্দী থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত সংঘটিত ক্রুসেড ও রেনেসাঁর ফলে এমনিতেই ইটালীর শহরগুলো বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত হয়। তাই বাণিজ্যিক কারণে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের দেশগুলোর প্রয়োজন হয়ে পড়ে নতুন নতুন ভূ-খণ্ড খুঁজে বের করা। তবে বেশ কিছু ঘটনা মানুষের এ সব আকাঙ্খার বাস্তবায়নে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। এ সময় সমুদ্রে চলার জন্য দিকদর্শন যন্ত্র আবিষ্কার। এ যন্ত্র আবিষ্কারের ফলে সমুদ্রে নাবিকদের পক্ষে দিক নির্ণয় করা সহজ হয়ে পড়ে।
.
একাদশ শতাব্দীতে ভাইকিংরা গ্রিনল্যান্ড, লাবরেডব এবং ম্যাগাচুসেটস এ গিয়েছিল। যেহেতু এসব স্থানে তাদের অর্থনৈতিক বা অন্য কোনো স্বার্থ তেমন ছিল না, তাই সেগুলো ভৌগোলিক আবিষ্কার হিসেবে তেমন গুরুত্ব পায়নি। পশ্চিম ইউরোপ তখন পর্যন্ত কেবল ভারতবর্ষ, চীন ও ইন্দোনেশিয়ার সাথে পরিচিত ছিল। মার্কোপোলো নামক একজন ইতালীয় পর্যটক তাঁর রচিত "Travels of Marcopolo" গ্রন্থে এসব দেশের যে বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন তাতে মানুষ এশিয়া সর্ম্পকে আরো বেশি উৎসাহী হয়ে উঠে। তবে ভৌগোলিক আবিষ্কার সত্যিকার অর্থে ঘটেছিল পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে। ওই সময়ে আবিষ্কারের নতুন পথ ও নতুন ভূমি বাস্তব সত্যে রূপ নেয়, এ সব অভিযানে আকস্মিক কোনো ব্যাপার ছিল না, বরং তা ছিল পরিকল্পিত, সংঘবদ্ধ ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞা শক্তিরূপে। তবে মজার ব্যাপার হলো ভৌগোলিক আবিষ্কারের ইংল্যান্ড, হল্যান্ড কিংবা ইতালির মত শক্তিশালী দেশ উদ্যোগী না হয়ে বরং স্পেন ও পর্তুগালের মত অপেক্ষাকৃত অনুন্নত দেশই তাতে নেতৃত্ব দিয়েছে, অংশগ্রহণ করেছে। পরে যখন দখলকৃত এলাকা পুনর্দখলের প্রয়োজন হয়ে পড়ে তখন অভিজাত গোষ্ঠী তাতে অংশগ্রহণ করে।
.
পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বেশ কিছু অগ্রগতি সাধিত হয়, যা ভৌগোলিক আবিষ্কারকে ত্বরান্বিত এবং সম্ভব করেছিল। এসব প্রযুক্তির মধ্যে ছিল ওয়াটার হুইল যা জাহাজে চাকা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এগুলো তৈরির জন্য গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন ওয়ার্কশপ। ষোড়শ শতাব্দীতে মাস্কেট নামক বড় ধরনের রাইফেল আবিষ্কৃত হয়। সমুদ্রে জলদস্যুদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নাবিকদের এসব রাইফেলের খুব প্রয়োজন ছিল। নৌচালনা বিদ্যা, জাহাজ তৈরি, কম্পাস যন্ত্র ও উন্নত পাল ইত্যাদির আবিষ্কার এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। চতুর্দশ শতাব্দীতে ইউরোপীয়রা কাগজের আবিষ্কার সম্পর্কে জানতে পারে। পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে জার্মানীর মেইনজ শহরের জোহান গুটেনবার্গ নামক একজন ব্যক্তি প্রিন্টিং টাইপ ও প্রেসযন্ত্র আবিষ্কার করেন। এ সব আবিষ্কারের ফলেই তৎকালীন ইউরোপে যে পরিবর্তন শুরু হয় ভৌগোলিক আবিষ্কার এর মধ্যে অন্যতম।
.
ভৌগোলিক আবিষ্কারসমূহ : পর্তুগীজ এবং স্পেনিশ নাবিকরা মহাসাগর অতিক্রম করার জন্য প্রথম যাত্রা শুরু করেন। সমুদ্রে তীরে অবস্থিত বহু পর্তুগীজের পেশা ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য ও মাছ ধরা, ফলে এরা বেশ সাহসী ও উদ্যমী ছিল। পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে পর্তুগীজরা আফ্রিকার পশ্চিম তীরের সন্ধানে আটলান্টিক মহাসাগরে যাতায়াত করত। এর বাইরে যেতে তারাও ভয় পেত। পরে অবশ্য বিষুব অঞ্চলে প্রবেশের মাধ্যমে তারা আফ্রিকার বন-জঙ্গল ও বন্যজন্তুর সন্ধান লাভ করে। পর্তুগীজরা প্রথমে আফ্রিকায় স্বর্ণ ও কাঁচ সংগ্রহ করে। পরে অবশ্য ইউরোপীয়রা আফ্রিকার অধিবাসী কালো লোকদের ধরে দাস হিসেবে বিক্রি শুরু করে। রাষ্ট্রীয় সহায়তায় পর্তুগীজ নাবিকগণ বেশ কিছু অভিযান চালিয়েছিল। পর্তুগীজ নাবিক বার্থামো দিয়াজ ১৪৮৭ সালে উত্তমাশা অন্তরীপ প্রদক্ষিণ করেন। তখন অবশ্য ভারতবর্ষে আসার জন্য এসব অভিযান পরিচালিত হয়েছিল।
.
স্পেনও তখন ভৌগোলিক আবিষ্কারে নাবিকদের সাহায্য প্রদান করতে থাকে। ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে কলম্বাস নামক জনৈক ইতালীয় নাবিক স্পেনের রানী ইসাবেলার অনুগ্রহে তিনটি জাহাজ এবং প্রয়োজনীয় রসদ নিয়ে প্রাচীন পৃথিবীর (প্রাচ্য দেশের) উদ্দেশ্যে বের হন। তাদের তখন পৃথিবীর মানচিত্র সম্পর্কে বেশি কিছু জানা ছিল না। তাই তিনি তার পরিচিত আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিলেই পুরাতন পৃথিবীতে (Old World) পৌঁছে যাবেন বলে ধরে নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। পাঁচ সপ্তাহ পর তিনি বর্তমান লাতিন আমেরিকার ক্যারিবীয় অঞ্চলের বাহামা দ্বীপপুঞ্জে প্রবেশ করেন। কলম্বাস ধরে নিয়েছিল তিনি পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে প্রবেশ করেছেন। কলম্বাস জানতেন না যে, তিনি আমেরিকা মহাদেশ আবিষ্কার করেছেন। কিন্তু প্রাচ্য দেশে তার আর পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। ১৫০৬ খ্রি. কলম্বাসের মৃত্যুর পর ইতালীর একজন তথ্য সংগ্রহকারী ব্যক্তি আমেরিগো ভেসপুসি প্রমাণ করলেন যে, কলম্বাস আবিষ্কৃত ভূ-খন্ডটি একটি নতুন মহাদেশ, তাঁরই নামের অনুকরণে এর নাম রাখা হলো আমেরিকা।
.
আমেরিকা মহাদেশ আবিষ্কার : ১৩ আগষ্ট ১৪৯২ সালে স্পেনের পেলোস বন্দর থেকে সান্তামারিয়া, পিন্তা ও নিনা নামে তিনটি পাল তোলা নৌকা করে কলম্বাস সমুদ্রে যাত্রা করেন। তিনটি নৌকায় সব মিলিয়ে নাবিক ছিল ৯০ জন। যাত্রার আড়াই মাস পর পিন্তা নৌকার অন্যতম নাবিক বদরিগো ত্রিয়ানা ভূমির দৃশ্য প্রথম অবলোকন করেন। এর ফলে নতুন একটি জগৎ আবিষ্কৃত হয়। কলম্বাসের নেতৃত্বে উক্ত নৌযান বাহামার গুয়ানাহানিতে প্রথম অবতরণ করে। তিনি এর নাম দিয়েছিলেন সেন্ট সালবদর (মুক্তিদাতা), সেখান থেকে অক্টোবর মাসে পৌঁছে ছিলেন উত্তর কিউবাতে, ডিসেম্বর মাসে আবিস্কৃত হয় হাইতি, তিনি এর নাম রেখেছিলেন হিস্পানিওলা (ক্ষুদ্র স্পেন)। ১৪৯৩ থেকে ১৪৯৬ খ্রি. মাঝামাঝিতে তার নেতৃত্বে পরিচালিত দ্বিতীয় অভিযানে তিনি সাথে নিয়ে ছিলেন ১৭টি জাহাজ এবং ১৫০০ সৈনিক-নাবিক। দ্বিতীয়বার অভিযানে জামাইকা, গুয়েত্রো রিকো এবং লেসার এ্যন্টাইলেস আবিস্কৃত হয়। ১৪৯৮ থেকে ১৫০০ খ্রি. পরিচালিত তৃতীয় অভিযানে হাইতিতে কলম্বাসের আগমনকে নিয়ে সংঘর্ষ বাঁধে এবং তিনি স্পেনে একজন বন্দি হিসেবে আনীত হন। ১৫০২ খ্রি. চতুর্থ অভিযানে কলম্বাস পানামা, কোস্তারিকা, নিকারাগুয়া এবং হন্ডুরাস আবিষ্কার করেন। তবে আমেরিকা মহাদেশ আবিষ্কার ভূগোল সম্পর্কে মানুষের ধারণাকে পরিবর্তন করে দেয় এবং মানব সভ্যতা এরপর থেকে একটি নতুন স্তরে উন্নীত হয়।
.
ভারতবর্ষে জলপথ আবিষ্কারে ভাস্কোদাগামা : স্পেনিশরা যখন পশ্চিমে অভিযান পরিচালনায় ব্যস্ত, পর্তুগীজরা তখন ভারতবর্ষে যাওয়ার পথ খুঁজছিল। ১৪৯৭ সালের ৮ জুন পর্তুগালের রাজা লিসবন থেকে ৪টি জাহাজ যোগে ভাস্কোদাগামাকে প্রেরণ করলেন। ১লা মার্চ ১৪৯৮ খ্রি. পর্তুগীজরা মোজাম্বিকে পৌঁছে। এর পরের জলপথ নিয়ে আরবের শেখদের মধ্যে বিরোধ ছিল। অবশেষে দক্ষিণ ভারতের কালিকটে তিনি পৌঁছেছিলেন ২ মে ১৪৯৮ সালে, তারা পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ মালয়, মালাবার প্রভৃতি অঞ্চলে অবতরণ করে এবং মসলার ব্যবসায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ইউরোপে এসব মসলা ২০০ থেকে ২৫০ গুণ বেশি মূল্যে বিক্রি হত। গোটা ষোড়শ শতাব্দী জুড়ে ভৌগোলিক আবিষ্কারের নতুন নতুন উদ্যোগ গৃহিত হয়। এ পরিস্থিতিতে স্পেন ও পর্তুগালের মধ্যে বিরোধ বাড়তে থাকে। উভয় পক্ষেই পোপের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করলে তিনি পশ্চিমে একটি কাল্পনিক রেখা টেনে পৃথিবীকে ২ ভাগে ভাগ করে দেন। কাল্পনিক রেখার পশ্চিম দিকে স্পেন এবং পূর্বদিকে পর্তুগাল, ইতিহাসে একে ‘ন্যায্য বিচার’ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে।
.
উত্তর আমেরিকা, কানাডা ও প্রশান্ত মহাসাগর আবিষ্কার : প্রশান্ত মহাসাগর- কলম্বাসের ধারণা ছিল যে, তিনি সকল অঞ্চল আবিষ্কার করেছেন সেগুলো পুরাতন পৃথিবীর (Old World) পূর্বাঞ্চল। প্রশান্ত মহাসাগরের কাছাকাছি এসেও তিনি অবশ্য সে রকম কিছু দেখতে পাননি। ১৫১৩ খ্রিস্টাব্দে পানামার এক পর্বত থেকে ভাস্কো ডে ব্যালবোয়া (Vatsco de Balboa) নামক একজন স্পেন দেশীয় নাবিক প্রশান্ত মহাসাগর অবলোকন করেন। এ ঘটনার আগেই ১৫০১ থেকে ১৫০৪ খ্রি. মধ্যে আমেরিগো ভেসপুচি দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিল নামক স্থানে পৌঁছান। এই অংশই আমেরিকা নামে পরিচিত হয়। মজার ব্যাপার হলো বর্তমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা ভূ-খন্ড কলম্বাসের জীবিতকালেই বৃটেনে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী ইতালীয় নাবিক জন ক্যাবট আবিষ্কার করেন। ১৪৯৭-৯৮ খ্রি. তিনি নিউ ফাউন্ডল্যান্ডের বেলাভূমিসহ উত্তর আমেরিকার বেশ কয়েকটি সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে অবতরণ করেন। পর্তুগীজ নাবিক ফেরনান্দো মেগেলান ১৫১৯ থেকে ১৫২২ খ্রি. আটলান্টিক মহাসাগর অতিক্রম করে দক্ষিণ আমেরিকার শেষপ্রান্ত হয়ে প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দেন, ফিলিপাইনে তাকে হত্যা করা হলে তার দলবল আফ্রিকার সর্বদক্ষিণে অবস্থিত উত্তমাশা হয়ে পশ্চিম আফ্রিকা অতিক্রম করে আবার স্পেনে ফিরে আসেন। এই বিশ্বভ্রমণে বের হওয়া ২৬৫ জনের মধ্যে মাত্র ১৮ জন নাবিক শেষ পর্যন্ত জীবিত অবস্থায় ফিরে আসতে সক্ষম হন।
.
অষ্ট্রেলিয়া আবিষ্কার : কোন দেশের নাবিক বা বণিকরা অষ্ট্রেলিয়া প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন তা জানা যায়নি। স্পেন, পর্তুগাল, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স সবাই দাবি করে তারা প্রথম এসেছিল। তবে পর্তুগীজ বণিকরাই সম্ভবত ১৫২৪ থেকে ১৫৪২ সালের মধ্যে দেশটি প্রথম দেখতে পায়। পেরু থেকে এসেছিলেন অ্যালভারো মেন্ডানা দ্য নেয়রা। ১৫০৩ সালের পরে তিনি প্রশান্ত মহাসাগরে জাহাজ ভাসিয়েছিলেন। এসেছিলেন সলোমন দ্বীপপুঞ্জে, ভেবেছিলেন তিনি একটি মহাদেশ আবিষ্কার করেছেন।
অষ্ট্রেলিয়ার প্রথম দিকের যে মানচিত্র আঁকা হয়েছিল তাতে কেবল পর্তুগীজদের নামই ছিল। তা থেকে ফরাসি ও ওলন্দাজরা নকল করে নেয়। সেই পর্তুগীজ নাবিকদের কেউ মনে রাখেনি। অষ্ট্রেলিয়ার সন্ধানে এসেছিলেন স্পেনের পেড্রো ফার্নান্ডেজ কুইরোস। তিনি নিউ হেব্রাইডিস দ্বীপ (এখনকার ভানুআতু প্রজাতন্ত্র) আবিষ্কার করে এটির নাম দেন অষ্ট্রেলিয়া। আসলে অষ্ট্রেলিয়া আবিষ্কারের কাজটি করেছিলেন তার সহকারী লুই ভেইজ দ্য টরেস। নিউগিনির উপকূল ধরে তিনি একটি প্রণালীতে পৌঁছান। এই প্রণালীর একদিকে নিউগিনি অপরদিকে অষ্ট্রেলিয়া। তিনি প্রণালীর অপরদিকে যেতেই পারেননি। তার ধারণা হলো ওপারে বড় বড় কতগুলো দ্বীপ আছে। বর্তমানে যাকে কুইনসল্যান্ড বলে। ১৬০৬ সালে টরেস যখন জাহাজে করে প্রণালী পার হচ্ছিলেন তখন ডয়ফেন নামক আর একটি ওলন্দাজ জাহাজও ওই দিকে যাচ্ছিল। ওই জাহাজ ডাঙ্গায় নোঙ্গর করা মাত্র আদিম অধিবাসীরা কয়েকজন ওলন্দাজকে মেরে ফেলে। এই জাহাজের নাবিক ছিলেন ভিলেম জানসজ। তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন উত্তর অষ্ট্রেলিয়ায়। এর দশ বৎসর পরে ডার্ক নামে এক ওলন্দাজ জলদস্যু অষ্ট্রেলিয়ার পশ্চিম উপকূলে পৌঁছেন। তিনি একটি খুঁটিতে পেরেক দিয়ে খাবার ডিশ আটকে লিখে দেন তার দলের সঙ্গীদের নাম। আরও লিখেন যে, তাঁরা ১৬১৬ সালের ২৫ শে অক্টোবর পৌঁছেছেন। ১৬৯৭ সালে আরেক ওলন্দাজ ক্যাপ্টেন ভিøøমিং সেখানে পৌঁছে সেই খুঁটি উপড়ে ফেলে নিজের নাম লেখা একটি সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে দেন।
.
এরপর ইংরেজ জলদস্যু ও ক্যাপ্টেন ডাম্পিয়ের তাঁর জাহাজ নিয়ে দুবার অষ্ট্রেলিয়ার উপকূলে আসেন। ১৭০৩ সালে ডাম্পিয়ের অভিযানে এক বিখ্যাত নাবিক ছিলেন আলেকজান্ডার সেলকার্ক। অবাধ্যতার জন্য ডাম্পিয়ের তাকে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের জুয়ান ফার্নান্ডেজ দ্বীপে নামিয়ে দিয়ে যান। সেখানে একা তাকে চার বৎসর থাকতে হয়। তার কথা শুনে ইংরেজ লেখক ড্যানিয়েল ডিফো লিখেছিলেন তার বিখ্যাত গ্রন্থ রবিনসন্স ক্রশো। এর পর আসেন ইয়র্কশায়ারের ক্যাপ্টেন কুক (১৭২৮-১৭৭৯) তিনিই অষ্ট্রেলিয়ার বহু অংশ আবিষ্কার করেন। ঘুরে আসেন নিউজিল্যান্ডের চারদিক, কুকই জানান অষ্ট্রেলিয়া দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত বিস্তৃত নয়।
.
আফ্রিকার অভ্যন্তরে আবিষ্কার : ইউরোপের অতি কাছে হলেও একশত বছরের বেশি সময় আগেও আফ্রিকা মূলত ব্যাপকভাবে অপরিচিত ছিল। আফ্রিকার উপকূল ব্যতীত অভ্যন্তর ভাগে খুব বেশি অভিযান পরিচালিত হয়নি। শুধু মাত্র আফ্রিকার সমুদ্র উপকূলে কাঠ, হাতির দাত এবং দাস ব্যবসা কেন্দ্র গড়ে উঠে এবং সেখানে কিছু বন্দরের পত্তন হয়। ১৮ শতকের মাঝামাঝি অবধি আফ্রিকার অভ্যন্তরে খুব কমই অভিযান পরিচালিত হয়েছে এবং খুব অল্প সংখ্যক উপনিবেশ গড়ে উঠেছে। অ্যাঙ্গোলা ও মোজাম্বিক ছিল পর্তুগালের অধীনে, দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ কলোনি ছিল বৃটেনের অধীনে আর পশ্চিম আফ্রিকা ছিল ফ্রান্সের অধীনে।
.
১৮৬০ ও ১৮৭০ এর দশকে লিভিংস্টোন ও স্ট্যানলি কঙ্গো ও নাইজার নদী হয়ে আফ্রিকার অভ্যন্তরে অভিযান পরিচালনা করেন আবিষ্কার হয় ভিক্টোরিয়া জলপথ। আর আফ্রিকার এ অভিযানের ফলে সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপীয়দের আফ্রিকার সম্পদের প্রাচুর্য সম্পর্কে আগ্রহের সৃষ্টি হয়। আর যার ফলশ্রুতি ১৮৮০ এর দশকে ইউরোপের দেশগুলো আফ্রিকায় উপনিবেশ গড়তে নিলর্জ্জের মতো কাড়াকাড়ি শুরু করে দেয়। ঊনিশ শতকে আফ্রিকার একমাত্র দেশ লাইবেরিয়া ব্যতীত প্রতিটি দেশে ইউরোপীয়রা তাদের উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। লাইবেরিয়ানরা ছিল আফ্রিকার প্রত্যাগত দাস বংশধরদের পূনর্বাসিত দেশ। যারা সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর উপনিবেশগুলিতে শ্রমে নিয়োজিত ছিল। তাদের বংশধরকে পূনর্বাসন করা হয়েছিল এই লাইবেরিয়ায়। লাইবেরিয়া ও আফ্রিকায় গঠিত হলেও এটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর সৃষ্টি করা একটি দেশ মাত্র।
.
তবে প্রথম দিকে সম্পদ সংগ্রহ বা আহরণের উদ্দেশ্যে ভৌগোলিক আবিষ্কারসমূহ পরিচালিত হলেও ক্রমে দেশ দখল গুরুত্ব পেতে শুরু করে। এর ফলে উপনিবেশ স্থাপন ও দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা পায়, ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলেই ইতিহাস উপনিবেশবাদের প্রতিষ্ঠা ও সম্প্রসারণ ধনী দেশগুলোর রাজনীতিতে স্থান করে নেয়। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়া ও অষ্ট্রেলিয়া মহাদেশসমূহের উপর ইউরোপের কতিপয় দেশের দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা এবং ওইসব অঞ্চল থেকে সম্পদ পাচারের অগ্রগতি ওই সময় পরিচালিত হয়। এসব মহাদেশ শোষণ-বঞ্চনার শিকার হয়। এসকল দেশের সম্পদের উপর নির্ভর করেই গড়ে ওঠেছে আধুনিক উন্নত দেশগুলোর সভ্যতা ও সংস্কৃতি।
Home »
৪. আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি
,
৫. ভূগোল (বাংলাদেশ ও বিশ্ব) পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
» ভৌগোলিক আবিষ্কার ও সাম্রাজ্যবাদ
ভৌগোলিক আবিষ্কার ও সাম্রাজ্যবাদ
By ─────────────── সেপ্টেম্বর ০৬, ২০১৯
❒❒ Transformation of Sentences-এর ওপর আপনার পছন্দের পোস্ট/আর্টিকেল পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুন/প্রবেশ করুন:
.....................................................................